মমতার একাধিক দুর্নীতি সম্পর্কে দীপক ঘোষের লেখা ‘মমতা ব্যানার্জি এজ আই হ্যাভ নোন হার’ বা ‘মমতা ব্যানার্জিকে আমি যেমন চিনেছি’; বইটিতে মমতার একাধিক দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছেন
দীপক ঘোষ হলেন প্রাক্তন আইএএস। তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে তিনি বিধায়কও হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। সিঙ্গুর-নন্দীরগ্রাম আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু ‘দলবিরোধী’ কার্যকলাপের অভিযোগে তিনি বহিষ্কৃত হন। এর পর ২০১২ সালের মে মাসে ‘মমতা ব্যানার্জি অ্যাজ আই হ্যাভ নোন হার অর দ্য গডেস দ্যাট ফেইলড’ শীর্ষক একটি বই বের করেন তিনি। এই বইটির বঙ্গানুবাদও পরে বেরোয়, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেমন দেখেছি’।
‘কলকাতা প্রকাশন’ কর্তৃক প্রকাশিত এই বইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক অজানা কাহিনী তুলে ধরেছেন দীপকবাবু। নানা বিস্ফোরক তথ্য রয়েছে তাতে।
এই বইটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, তাঁর পরিবার ও তৃণমূল কংগ্রেস দল সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের একুশটি অভিযোগ তুলে ধরেছেন দীপক ঘোষ। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন ফেলেছে মমতা ব্যানার্জীর ‘২৫ দিনের অনশন’ বিষয়ক ঘটনাটি।
বইটিতে তিনি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি থেকে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার নিয়ে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগের কথা। দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বইটির লেখক দীপক ঘোষ। সেই চিঠির প্রতিলিপি তিনি পাঠিয়েছেন সোনিয়া গান্ধী, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং মুখ্য নির্বাচনী অফিসারকে। চিঠির সঙ্গে সদ্য প্রকাশিত বইটির প্রতিলিপিও পাঠিয়েছেন প্রাক্তন এই তৃণমূল বিধায়ক। চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার, পারিষদ এবং তৃণমূলের একাধিক গরমিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন মমতা ব্যানার্জির এই পদে থাকা দলের সংবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ।
আরেকটি জায়গাতে তিনি লিখেছেন, সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানার বিরোধিতা করে ২৬ দিন অনশন করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেই অনশনে নৈশভোজ ও চকোলেট খেয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। এক জায়গায় লিখেছেন, গ্রাসরুট ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ২০০২ সালে তৃণমূলের নেতারা গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু জনকল্যাণের বদলে আসলে মমতা ব্যানার্জি ও অন্যান্য তৃণমূল নেতাদের স্বার্থ চরিতার্থ করছে ওই প্রতিষ্ঠান। আবার দার্জিলিং পাহাড়ের গোর্খাল্যান্ড সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদক্ষেপকে ভুল বলে অভিযোগ করেছেন দীপক ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, পাহাড়ে অশান্তি তো থামেইনি বরং ক্রমেই সিঁদুরে হচ্ছে পাহাড়ের আকাশ।
দীপক ঘোষের বইটি উদ্বোধন করে মমতা ব্যানার্জির অনুগত শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল জানান, বিস্ফোরক তথ্য রয়েছে এই বইটিতে। তবে এই বইপ্রকাশ ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে প্রেসক্লাবের পরিস্থিতি। ফলে তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিতে হয় অনুষ্ঠান। তবে আগামীদিনে যে এই বই এইরাজ্যে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর দীপক ঘোষের দল থেকে বহিস্কারও যে কেবল সময়েরই অপেক্ষা, বলাই বাহুল্য।
তৃনমুলের প্রবীন এই নেতা এবং মমতার অত্যন্ত কাছের মানুষ দীপক ঘোষ বইটির অষ্টম পরিচ্ছদে লিখেছেন, ‘যাঁরা বিশ্বাস করেন যে মমতা ব্যানার্জি ২৫ দিন অনশন করেছিলেন, তাদের জানার কোনো উপায়ই নেই যে তাঁর সেই অনশন ছিলো রাতে স্যান্ডউইচ ও দিনভর চকোলেট খেয়ে’। সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানীর কারখানা তৈরীর বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে জোর করে জমি কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলে ৪ঠা ডিসেম্বর ২০০৬ থেকে মমতা ব্যানার্জি কলকাতার ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে বিশাল মঞ্চ বেঁধে ‘আমরণ অনশন’ করেছিলেন। সেই অনশন চলেছিল টানা ২৫ দিন। ২৬ দিনের দিন আচমকাই সেই অনশন প্রত্যাহার করা হয়। ওই অনশনকে এখনো ঐতিহাসিক ও গান্ধীজীকেও অতিক্রম করা অনশন বলে দাবি করেন স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু সেই সময় মমতা ব্যানার্জির খুবই ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা দীপক ঘোষ তাঁর লেখা বইয়ে জানিয়েছেন, ”…..২০০৬ সালের ২ রা ডিসেম্বর সিঙ্গুরে গোলমালের পরেরদিন ৩ রা ডিসেম্বর মমতার বাড়ির অফিসে একটা মিটিঙের পর হঠাৎই ঘোষণা হয় যে তিনি পরেরদিন থেকে অনশন করবেন ধর্মতলায়। খুব দ্রুত মেট্রো চ্যানেলে পশ্চিম ফুটপাতে মঞ্চ তৈরি হয়। তাতে রাখা হয় পাঁচটি চৌকি। দুটো চৌকি সামনে, তিনটে একটু পিছনে। মহিলাদের ব্যবহারের জন্য একটি বাথরুমও তৈরি হয়। একটি পর্দার ব্যবস্থা হয়েছিলো। রোজ রাত ৯টায় সেই পর্দা দিয়ে মঞ্চ ঢাকা হতো। পরেরদিন সকাল ১০টায় পর্দা উঠতো। অনশনকারীরা যাতে রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারেন, তাই এই ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল।…….সোনালী গুহ ও বর্ণালী মুখার্জি অনশন মঞ্চে সামনের দুটো চৌকিতে অনশন শুরু করেছিলেন। পিছনের তিনটি চৌকির দক্ষিণ পশ্চিমের চৌকিতে ছিলেন মমতা। উত্তর-পশ্চিমের চৌকিতে ছিলেন বিজয় উপাধ্যায়। মাঝখানের চৌকিতে নকশালপন্থী নেতা আভাস ঘোষ। অনশনের তৃতীয় দিনে কোনো একটি ধর্মীয় স্থানে মানত রক্ষার ব্যাপার আছে বলে জানিয়ে সোনালী গুহ অনশন মঞ্চ ছেড়েছিলেন। ৬দিন বাদে বর্ণালী মুখার্জিও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতটাই যে নড়তে পারছিলেন না। ১৮ দিনের মাথায় আভাস ঘোষকে জোর করে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’’ দীপক ঘোষ তাঁর লেখায় সেইসময় মমতাসঙ্গী বিজয় উপাধ্যায়ের অনশন কীভাবে ছিল, তা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘রোজ ভোরে বিজয় উপাধ্যায় চৌকি ছেড়ে, মঞ্চ থেকে নেমে, হেঁটে বিপরীতে জওহরলাল নেহরু রোডে যেতেন। ১নং চৌরঙ্গী রোডে অভিজাত নিরামিষ হোটেল রেস্তোরাঁয় একটি রুম বুক করা থাকতো। সেখানে স্নান করতেন। তারপর ওই হোটেলে দুপুরের খাওয়ার মতো করে পরিমাণমত প্রাতঃরাশ করতেন। সকাল ১০টায় মঞ্চের পর্দা ওঠার আগেই তিনি চৌকিতে ফিরে আসতেন। রাতে পর্দা পড়লে তিনি আবার হোটেলে যেতেন, ভরপেট রাতের খাবার খেতেন। এক গ্রাম ওজনও কমেনি তাঁর অনশনের সময়।……তাঁর এই নজিরবিহীন অনশনের দিনগুলিতে কী করতেন মমতা? অনশনের প্রথম দু-তিনদিন তাঁর সঙ্গে থাকতো লেবুর জল ও গ্লুকোজের জল। মমতাকেও দেখতাম পর্দা ওঠার পর সারাদিন মঞ্চে শুয়ে, বসে অথবা দাঁড়িয়ে, হেঁটে সবসময় নেতাদের নির্দেশ দিতেন, ভাষণ দিতেন। পুরো সভা পরিচালনা করতেন। গান বাজনাও হতো!……কিন্তু দৃশ্যপট থেকে সোনালী গুহ উধাও হয়ে যাওয়ায় তিনি ডেরেক ও ব্রায়েনের সৌজন্যে কলকাতার ঝাউতলা এলাকার ডালহৌসি ইনস্টিটিউট থেকে নিজের পি এ গৌতম বসু (২০০৮ সালে মারা যান তিনি)-কে দিয়ে চার-পাঁচটি চিকেন অথবা চিজ স্যান্ডউইচ আনাতেন তিনি ( ডেরেক ও ব্রায়েনকে মমতা রাজ্যসভার সাংসদ করেছেন ২০১১ সালের জুলাই মাসে)। মমতা অনশন মঞ্চে তার বালিশের তলায় দামী চকলেট রেখে দিতেন। যখনই দরকার হতো, গোপনে তা মুখে পুরে নিতেন। আমি এই সত্যটা আবিষ্কার করলাম অনশনের সময় একদিন বিকেলে। অনশনের অন্যতম সঙ্গী অমিতাভ ভট্টাচার্য তার ছোট ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন সেদিন। মমতা সেই শিশুকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে ওর হাতে চকোলেট গুঁজে দিয়েছিলেন। তখনই সত্যটা খুঁজে পাই আমি। রাতে স্যান্ডউইচ আর দিনে চকোলেট, এই ছিলো মমতার সেই সময়ের অনশন!
……..২৮ শে ডিসেম্বর ২০০৬ রাত ৯ টা নাগাদ আমি গুজব ছড়িয়ে দিই যে, ইস্টার্ন আর্মি হাইকমান্ড গোপন নির্দেশ পেয়ে অনশন মঞ্চে আসছে মমতাকে জোর করে হাসপাতালে নিতে। এই গুজবের পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল, মমতা সত্যিই অনশন করছেন কিনা, তা আরো যাচাই করে দেখা। গুজব শুনে মমতা খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। রাত ১০টা নাগাদ তিনি আচমকা বললেন, তাঁর খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ডাঃ কাকলি ঘোষদস্তিদার আগাম ব্যবস্থা করে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার সাজিয়ে, মমতাকে সেই অক্সিজেন মাস্ক পরাতে গেলেন, মমতা বাধা দিয়ে বললেন, তিনি তার নাসারন্ধ্রে দুটো নল ঢুকিয়ে নিয়েছেন। শুনে কাকলি ও আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ওইদিনই গভীর রাতে তাঁকে মঞ্চ থেকে স্ট্রেচারে করে সরানো হয়েছিল। সাদার্ন অ্যাভিনিউর অভিজাত নার্সিংহোমের দোতলার রুমে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল। আমিও ছিলাম সেই নার্সিংহোমের সামনে। মমতার কালীঘাটের বাড়ির এলাকার বেশ কিছু ছেলেও ছিল ওই রাতে। তাদের চোখে মুখে ‘দিদি’র জন্য উদ্বেগ। কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে রাতে স্যান্ডউইচ আর দিনে চকোলেট খেয়ে অনশন চলেছে ধর্মতলায় সিঙ্গুর ইস্যুতে’।