মাত্র দেড় মাস আগে, গত ১১ ডিসেম্বর ছিল পরীক্ষা। সেই টেটের ওএমআর শিট, একাধিক টেট পরীক্ষার্থীর অ্যাডমিট কার্ডও মিলেছে নিয়োগকাণ্ডে ধৃত যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষের ফ্ল্যাটে। ইডি’র তল্লাশিতেই তা মেলে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, সদ্য শেষ হওয়া টেটের ১৮৯টি ওএমআর শিট মিলেছে তল্লাশিতে। এনিয়েই বিস্ময়প্রকাশ করেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, কী করে কুন্তলের কাছে OMR শিট এবং অ্যাডমিট কার্ড গেল? তা ED-কে ডেকে জিজ্ঞাসা করব।
নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষের। রাজারহাটের ফ্ল্যাট থেকে প্রায় ২০০টি OMR শিট পাওয়া গেছে। মাত্র দেড় মাস আগে যে টেট হয়েছে, তারও OMR শিট কুন্তল ঘোষের বাড়িতে। আর তাই জোরাল প্রশ্ন উঠছে, নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ো এত তোলপাড়, এত তদন্ত, এত গ্রেফতার, এত প্রতিবাদ, এত সমালোচনার পরও কি অর্থের বিনিময়ে চাকরি বিক্রির চক্র রমরমিয়ে চলছে?
কুন্তল ঘোষকে গত নভেম্বরে যুব তৃণমূল অন্যতম রাজ্য সম্পাদক পদে বসানো হয়। তার দিন পনেরোর মধ্যেই প্রাথমিক নিয়োগের এই পরীক্ষা হয়েছিল রাজ্যে। পর্ষদের তরফে সদ্য শেষ হওয়া টেট নিয়ে বিস্তর দাবি করা হলেও সেই পরীক্ষার ওএমএর শিটের কপি যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদকের বাড়িতে মেলায় স্বাভাবিকভাবেই ফের টেট দুর্নীতির প্রশ্ন সামনে এসেছে।
এদিন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের আইনজীবীর তরফে যদিও আদালতকে জানিয়েছেন এই ওএমআর শিট এবং অ্যাডমিট কার্ডের ব্যাপারে পর্ষদের কোনও গাফিলতি নেই। স্বচ্ছতা বজায় রেখে পর্ষদ টেট পরিচালনা করেছে। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ১১ডিসেম্বর টেট হয়েছিল। অল্প সময়ের ব্যবধানেই সেই টেটের ওএমআর এবং অ্যাডমিট কার্ডও তৃণমূলের নেতা কুন্তল ঘোষের বাড়িতে পৌঁছে গেছে।
সূত্রের দাবি, OMR শিটের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, যুব তৃণমূলের রাজ্য় সম্পাদক কুন্তল দাবি করেন, RTI-করে এই OMR শিটগুলো বের করেছি। তখন কুন্তলকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন RTI-করে এতগুলো OMR শিট বের করেছেন? সূত্রের দাবি এবিষয়ে কোনও উত্তর দেননি ধৃত যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল।
পর্ষদের দাবি ওটা ওএমআর শিটের প্রতিলিপি। তা পরীক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছিল। ফলে কোনও পরীক্ষার্থীর মাধ্যমে কারো কাছে পৌঁছালে পর্ষদের দায় নয়। তবে গোটা ঘটনায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র দাবি- তাহলে বোঝা যাচ্ছে শেষবারের টেটেও টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়া, পরীক্ষা পাশ করিয়ে দেওয়ার সেই দালালচক্র সক্রিয় ছিল। যাদের ওএমআর শিট মিলেছে তাদের কাছ থেকে হয়তো আগাম টাকা চাওয়া হয়েছিল বা নেওয়া হয়েছিল পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার শর্তে। ফলে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ইডি-সিবিআই’র তদন্ত চলাকালীন রাজ্যের চতুর্থবারের মত টেট পরীক্ষাতেও যে আসলে দুর্নীতি, টাকা লেনদেনের বিষয় জড়িত তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে যুব তৃণমূল নেতার বাড়িতে অ্যাডমিট কার্ড এবং ওএমআর শিট মেলায়।
বিচারপতি বলেন, ‘ কিছু দালাল এখনও চাকরি বিক্রির চেষ্টা করছে, আর কিছু দালাল তাদের আড়াল করার। ‘
ইডি সূত্রে দাবি, যে সব চাকরি প্রার্থীর OMR-শিট পাওয়া গেছে, তাঁদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর পাশাপাশি, তাপস মণ্ডলের দেওয়া ৩৮৫ জনের তালিকার সঙ্গেও এই নামগুলির মিল আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
এদিন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ইডি সূত্রে জানতে পেরেছেন নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে একজন অভিনেত্রীর প্রসঙ্গেও। বিচারপতি তদন্তকারী সংস্থা ইডি-কে নির্দেশ দিয়েছেন ওই অভিনেত্রীর নাম জানিয়ে দ্রুততার সঙ্গে আদালতে হলফনামা জমা দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ‘নিয়োগ দুর্নীতিতে কোনও অভিনেত্রী জড়িত? নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে এক অভিনেত্রীর নাম উঠে এসেছে শুনেছি। তিনি নাকি তিনটি ফ্ল্যাট ভেঙে একটা বড় ফ্ল্যাট পেয়েছেন। জানতে চাই কে তিনি? এই অভিনেত্রীকে দেখতে চাই। তাঁর সিনেমাও দেখতে চাই।’
এই প্রতারক কুন্তল যে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার চক্রে যুক্ত তা এখন দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। শুধু তাই নয় হুগলীর বলাগড়েরই বাসিন্দা, তৃণমূলের জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শান্তনু ব্যানার্জির বাড়ি থেকেও টেটের নথি, অ্যাডমিট কার্ড মিলেছিল ইডি’র তল্লাশিতে। শাসক তৃণমূলই যে অবৈধ নিয়োগ চক্র চালাতো রাজ্যজুড় তা তদন্তের গতি প্রকৃতিতেই বারেবারে সামনে আসছে।
এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রে দাবি কুন্তল ঘোষ গত দেড়-দু’বছরে একাধিক গাড়ি কেনাবেচা করেছে। নিজের জেলা হুগলীর এক গাড়ি বিক্রেতার পাশাপাশি কলকাতা থেকেও গাড়ি কিনেছে। পুরানো গাড়িও কিনেছে গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। এমনকি প্রতারণার কারবারের একাধিক ব্যক্তিকে টাকা ফেরত দিতে না পারায় তার কেনা পুরানো গাড়িও চিনারপার্কের এক ব্যক্তি আটকে রেখেছে এমন ঘটনাও জানা গেছে।